প্রকৃতির মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক অসাধারণ সবজি, যার রক্তিম আভা শুধু প্লেটের সৌন্দর্য্যই বৃদ্ধি করে না, বরং স্বাস্থ্যের জগতে নিয়ে আসে এক বিপ্লব! হ্যাঁ, কথা বলছি বিটরুট(Beetroot) নিয়ে – একটি সহজলভ্য কিন্তু পুষ্টিতে ভরপুর সবজি, যা আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকাকে করে তুলতে পারে আরও বেশি শক্তিশালী।
এটি শুধু একটি সাধারণ সবজি নয়, বরং একে বলা যায় প্রাকৃতিক ওষুধ যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে এনার্জি বাড়ানো, এমনকি ক্যান্সার প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে। অথচ একটা সময় পর্যন্ত শ্রেফ খাবারে প্রাকৃতিক রঞ্জক পদার্থ হিসেবেই ব্যবহৃত হতো এই সবজিটি। আর বর্তমানে এর বিভিন্ন পুষ্টিগুণ এর জন্য গবেষণায় যেনো এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, দেখা মিলছে এর বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতার।
কিন্তু প্রশ্ন হলো — এই বিটরুট কীভাবে কাজ করে? কাদের জন্য এটি বিশেষ উপকারী, আবার কাদের জন্য হতে পারে ক্ষতির কারণ? চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
বিটরুটের পুষ্টিগুণ
বিটরুট পুষ্টিতে ভরপুর একটি সবজি। USDA এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা বিটরুটে সাধারণত নিম্নলিখিত পুষ্টি উপাদান থাকে:
- ক্যালোরি: ৪৩ কিলোক্যালরি
- কার্বোহাইড্রেট: ৯.৬ গ্রাম
- প্রোটিন: ১.৬ গ্রাম
- ফাইবার: ২.৮ গ্রাম
- ফোলেট (ভিটামিন B9): ১০৯ মাইক্রোগ্রাম (দৈনিক চাহিদার ২৭%)
- ম্যাঙ্গানিজ: ০.৩ মিলিগ্রাম (দৈনিক চাহিদার ১৬%)
- পটাসিয়াম: ৩২৫ মিলিগ্রাম
- আয়রন: ০.৮ মিলিগ্রাম
বিটরুটের গাঢ় লাল রং এসেছে বিটালেইন নামক এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থেকে, যা প্রদাহ কমাতে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বিটরুট (Beetroot) এর স্বাস্থ্য উপকারিতা
১। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ
বর্তমানের অতিরিক্ত প্রসেসড খাবারের ভিড়ে খাবার থেকে যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হারিয়ে যাচ্ছে তা হচ্ছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। বিটরুটে আছে পলিফেনল এবং অ্যান্থোসায়ানিন এর মতন প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এছাড়াও বিটালেইন – যা থেকে বিটরুটে গাঢ় বর্ণ এসেছে, এটিও বেশ শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। খাবারে এরূপ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর উপস্থিতি অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমানোর মাধ্যমে কোষের ক্ষয় রোধ করে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
২। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম
২০১৫ সালে পুরো বিশ্বে প্রায় ১৭.৫ মিলিয়ন ক্যান্সার রোগী ছিলো বলে গবেষণায় উঠে এসেছিলো যা ২০২৫ সালে এসে অবশ্যই আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যান্সারের বিভিন্ন চিকিৎসার পাশাপাশি খাদ্যতালিকায় বিটরুট রাখলে তা কিছু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেই বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বিটরুটে বিদ্যমান বিটানিন ত্বক ও ফুসফুসের কারসিনোজেনিক ধরনের টিউমার যা ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে, সেগুলোকে বাঁধা দিতে সক্ষম। তবে এই ক্ষেত্রে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন বলেও গবেষকেরা মনে করেছেন।
৩। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
বিটরুটে থাকা উচ্চ মাত্রার নাইট্রেট শরীরে গিয়ে নাইট্রিক অক্সাইডে রূপান্তরিত হয়, যা রক্তনালীকে প্রসারিত করে রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
৪। হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে
বিটরুটে উপস্থিত বিটালাইন রক্ত জমাট বাঁধা এবং ধমনীর শক্ত হওয়া (atherosclerosis) প্রতিরোধ করে। এছাড়া বিটরুটের ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে সাহায্য করে। যা হাইপারলিপিডেমিয়ার বিপরীতে কার্যকরী।
৫। রক্তশূন্যতা দূর করে
বিটরুটে আছে স্বল্প মাত্রায় আয়রন, ফোলেট এবং ভিটামিন C যা রক্তের হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সহায়তা করে ফলে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা দেখা যায়।
৬। ব্যায়ামের স্ট্যামিনা বাড়ায়
অ্যাথলেট বা যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাদের জন্য বিটরুটের রস একটি প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিংক। এতে উপস্থিত নাইট্রেট মাংসপেশিতে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে ক্লান্তি দূর করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়। তবে বিশেষ করে আরোবিক্স বা কার্ডিও জাতীয় ব্যায়ামের ক্ষেত্রে স্ট্যামিনা বাড়াতে কাজ করে বিটরুট।
৭। লিভার ডিটক্সিফিকেশন করে
বিটরুটের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও বিটাইন লিভার থেকে টক্সিন দূর করে এবং ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি কমায়। একই সাথে লিভারের টিউমার বা লিভারের কোষের ক্ষতি হওয়ার হাত থেকেও সুরক্ষা দেয়।
৮। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে
বয়স্কদের মধ্যে নাইট্রিক অক্সাইডের অভাবে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে পারে। বিটরুট মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ বাড়িয়ে আলঝেইমার ও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে।
৯। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
বিটরুটে থাকা বিটালাইন, পলিফেনল এবং নাইট্রেট ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তবে মিষ্টি স্বাদের কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিটরুট জুস করে না গ্রহণ করে সরাসরি গ্রহণ করা উত্তম।
বিটরুটের সম্ভাব্য অপকারিতা ও সতর্কতা
১. কিডনিতে পাথরের ঝুঁকি
বিটরুটে অক্সালেট বেশি থাকে, যা কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে। যাদের ইতিমধ্যেই কিডনিতে পাথর আছে, তাদের বিটরুট এড়িয়ে চলা ভালো।
২. রক্তচাপ অতিমাত্রায় কমিয়ে দিতে পারে
যারা ইতিমধ্যেই লো ব্লাড প্রেশারের রোগী বা ব্লাড প্রেশারের ওষুধ খান, তাদের বিটরুট অতিরিক্ত খেলে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যেতে পারে।
৩. গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা তৈরি করতে পারে
বিটরুটের ফাইবার হজমে সাহায্য করলেও অতিরিক্ত খেলে পেট ফাঁপা, গ্যাস বা ডায়রিয়া হতে পারে।
৪. গর্ভাবস্থায় সতর্কতা
গর্ভবতী নারীরা বিটরুট খেতে পারেন, তবে অতিরিক্ত নাইট্রেট গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া উচিত।
কাদের জন্য ভালো, কাদের জন্য ক্ষতিকর?
যাদের জন্য উপকারী:
- উচ্চ রক্তচাপের রোগী
- অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতায় ভুগছেন যারা
- অ্যাথলেট বা নিয়মিত ব্যায়াম করেন যারা
- লিভার ও হৃদযন্ত্রের সুস্থতা চান যারা
- ডায়াবেটিস রোগী (পরিমিত পরিমাণে)
যাদের এড়ানো উচিত:
- কিডনিতে পাথর আছে যাদের
- লো ব্লাড প্রেশারের রোগী
- গর্ভবতী নারী
- যাদের বিটরুটে অ্যালার্জি আছে
কীভাবে এবং কখন খাবেন?
সেরা সময়:
- সকালে খালি পেটে বিটরুটের রস বা সালাদ গ্রহণ করলে সর্বোচ্চ পুষ্টি পাওয়া যায়।
- ব্যায়ামের ১-২ ঘণ্টা আগে খেলে স্ট্যামিনা বাড়ে।
- খাবার গ্রহণের কিছুক্ষণ আগে গ্রহণ করলে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে আসে।
খাওয়ার উপায়:
- কাঁচা অবস্থায় সালাদ বা জুস করে।
- স্যুপ বা রান্নায় সবজি হিসেবে।
- চিপস বা হালুয়া বানিয়ে।
প্রতিদিন কতটুকু খাওয়া নিরাপদ?
– জুস: দিনে ১ গ্লাস
– কাঁচা বা রান্না করা: ১ মাঝারি আকারের বিটরুট (১০০-১৫০ গ্রাম)
বিটরুট প্রকৃতির দেওয়া একটি অসাধারণ উপহার, যা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় যোগ করে নেওয়া উচিত। তবে এর গুণের পাশাপাশি কিছু সতর্কতাও মেনে চলতে হবে। সঠিক পরিমাণে এবং সঠিকভাবে গ্রহণ করলে বিটরুট আপনার স্বাস্থ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। আজই শুরু করুন এই সুপারফুডের ব্যবহার, আর উপভোগ করুন প্রাকৃতিকভাবে সুস্থ থাকার আনন্দ!
Source :