অন্যান্য, রেসিপি

কালক্রমে কালা ভুনা

কালা ভুনা

মূলত চট্টগ্রামের না হলেও, ছোট থেকে চট্টগ্রামে বড় হবার কারণে সবাই ধরেই নেয় আমি চাঁটগাঁইয়া! 

এই ধরে নেওয়া থেকেই একবার বাড়ি যাবার কথা প্রসঙ্গে এক বন্ধু বলছিল,

“কি সুখ তোমার! চট্টগ্রাম যাবা, এরপর কালা ভুনা খাবা!” আমি বললাম, “আমি আসলে কালা ভুনা ঠিকমত চিনি না!” 

বন্ধু সাথে সাথে অবলীলায় বলে ফেললো, “আমি তোমাকে চিনিনা!!” 

এই হচ্ছে চাঁটগাঁইয়া কালা ভুনার জনপ্রিয়তা! 

রসনাবিলাসি বাঙালি মাত্রই গরুর মাংস প্রিয়! যে যতই কম খাক আর ডায়েট করুক, গরুর মাংসের কাছে এসে সবাই দুর্বল। গরুর মাংস রান্না হলে সবাই একটু চেখে দেখবেই। আর রান্নাটা যদি হয় কালা ভুনা, তাহলে তো আর কথাই নেই! 

গরুর মাংস কিংবা খাসির মাংস দুটা দিয়েই কালা ভুনা করা হলেও মূলত গরুর কালা ভুনাই বেশি জনপ্রিয়। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এই খাবার সেখানকার যেকোনো উৎসবে, অনুষ্ঠানে, কিংবা ঘরোয়া আয়োজনে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। 

পরিবারের নতুন শিশুর আকিকা, জন্মদিন, বিয়ে, খৎনা, কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা কোন বিশেষ ধর্মীয় ব্যাক্তির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এক বিশেষ দাওয়াতের আয়োজন করা হয়, যাকে বলা হয় মেজবান। চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় ‘মেজ্জান’। এই মেজবানের খাবারের ধাঁচই আলাদা! এই রান্নার স্বাদ, গন্ধ, রং সবই অন্য রান্নার তুলনায় বেশ অন্যরকম। 

তো আদিকাল থেকে এই ‘মেজ্জানের’ই একটি বিশেষ পরিবেশন ছিল গরুর কালা ভুনা। বিভিন্ন মেজবানে শুধুমাত্র কালা ভুনা রান্নার জন্য স্পেশাল বাবুর্চি থাকেন। এবং কালা ভুনার জনপ্রিয়তার কল্যাণে তারা নাকি দেশের বাহিরে গিয়েও নানান বাঙালি আয়োজনে এই স্পেশাল আইটেম রেঁধে আসেন! 

এখন তো শুধু চট্টগ্রামের মেজবান নয়, কালা ভুনা পাওয়া যায় সাড়া দেশের বহু রেস্তোরাঁতেও। ভোজনরসিক মানুষেরা সময়ের অভাবে চট্টগ্রামে আসতে না পারলেও যেন চট্টগ্রামের খাবার থেকে বঞ্চিত না হন, তাদের জন্য এই ব্যবস্থা বেশ সুবিধারই বটে!  

সাদা ভাত, পোলাও কিংবা পরোটা দিয়ে কালা ভুনার স্বাদের জুড়ি মেলা ভার। এছাড়াও মেইন কোর্স হিসেবেও অনেক সময় কালা ভুনার পরিবেশন হয়ে থাকে। 

রান্নাবান্না যে একটি সূক্ষ্ম শিল্প বৈ কিছুই নয়, তারই প্রমাণ পাওয়া যায় কালা ভুনায়। কালা ভুনা বিখ্যাত এর মুখরোচক স্বাদের জন্য। অনন্য এই স্বাদ আসে মূলত যথাযথভাবে সঠিক মশলার ব্যবহার এবং অথেনটিক রন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। 

চট্টগ্রামের বাহিরের অনেক মানুষের কাছেই কালা ভুনা মানে হল গোশত অনেক সময় নিয়ে ভাজতে ভাজতে রং বদলে বাদামি বা কালো এবং শুকনা শুকনা করে ফেলা! কিন্তু যাদের অঞ্চলের খাবার, সেই চাঁটগাঁইয়ারা জানে কালা ভুনা এর চে আরও অনেক শখের জিনিশ এবং আরেকটু কষ্টসাধ্যও বটে! 

শুধুমাত্র ভাজার কারণে এর কালো রং আসে না, বরং ধাপে ধাপে মসলার সঠিক ব্যবহারে আসে। আর কালা ভুনার টেক্সচারটা একেবারে শুকনাও হয় না; বরং ঠিকভাবে রান্না করা হলে একটু রসালো এবং খুবই নরম হয়। 

এত কথা যখন বলেই ফেললাম কালা ভুনার স্বাদ নিয়ে, তখন এর রেসিপিটাও তো না জানলেই না! 

চলুন তবে দেখে নিই চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কালা ভুনার মূল রেসিপি!

প্রথমে উপাদানগুলো জেনে নেইঃ

মাংস মেরিনেট করতে লাগবে- 

 – গরুর মাংস ১ কেজিঃ এক্ষেত্রে কিছু কথা না বললেই নয়। প্রথমত গরুর মাংসে হাড় চর্বি সবই থাকতে হবে। অনেকে মনে করেন কালা ভুনা তৈরিতে শুধু হাড়ছাড়া মাংস নিতে হয়, যা আদতে ঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, কালা ভুনা তৈরিতে একসাথে বেশ অনেক পরিমাণে মাংস নিতে হয়, কম মাংস দিয়ে কালা ভুনা করতে গেলে শেষটায় গিয়ে ভালো হয় না। আর মাংসের টুকরাগুলো একটু বড় বড় করে করতে হয়। 

 – কাঁচা পেঁয়াজ: ১/২ কাপ (বড় কিউব করে কাটা) 

 – পিঁয়াজ বেরেস্তা ১/২ কাপ

 – আদা বাটা ১/২ টেবিল চামুচ

 – রসুন বাটা ১/২ টেবিল চামুচ

 – গোল মরিচ ৫/৬ টি

 – ২/৩ টি ছোটো এলাচ

 – বড় এলাচ ২ টি

 – ২ টি তেজপাতা

 – লং ৩/৪ টি

 – কাবাব চিনি ৩/৪ টি

 – দারুচিনি আনুমানিক ৫/৬ সেঃমিঃ

 – স্টার এনিস মসলা ২/৩ টি

 – লবণ ১/২ টেবিল চামুচ

 – মরিচের গুঁড়ি ১ টেবিল চামুচ

 – হলুদের গুঁড়ি সোয়া চা চামুচ

 – ধনে গুঁড়ি ১ টেবিল চামুচ

 – সরিষার তেল ১/২ কাপ পরিমাণ (পেঁয়াজ বেরেস্তার তেলটাই নিতে হবে)

১। গরুর মাংস পরিষ্কার করে ধুয়ে নিয়ে এই সবগুলো উপাদান একে একে মাংসে দিয়ে এরপর মাংসটাকে ভালভাবে হাত দিয়ে মাখিয়ে নিন। এখানে বলে রাখা জরুরি যে মাংসটা যত ভালো করে মশলা দিয়ে মাখাবেন ততই এর ভিতরে মশলাগুলো ঢুকবে এবং রান্নার সময় এর স্বাদ খুলবে। তাই ৫/৭ মিনিট সময় নিয়ে উলটে পালটে মাংসটা মাখিয়ে নিয়ে ঢাকনা দিয়ে চুলায় দিয়ে দিন। 

কোন পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ফ্রেশ গরুর মাংস থেকে এমনিতেই পানি ছাড়বে। 

২। ৫ মিনিট উচ্চতাপে মাংসটা রান্না হলে, ঢাকনা সরিয়ে ভালভাবে উলটেপালটে দিন। এ পর্যায়ে দেখবেন মাংস থেকে সামান্য পানি ছাড়ছে। 

৩। এভাবে প্রতি ৫ মিনিট পরপর মাংসটা ভালভাবে নিচ থেকে উলটে পালটে দিন আর লক্ষ্য রাখুন যেন নিচে মশলাটা পুড়ে না যায়। 

৪। আনুমানিক ২০/২৫ মিনিট পর, যখন পানিটা শুকিয়ে তেল উপরে চলে আসবে এবং মাংসের রঙটাও খানিকটা বদলে যাবে, তখন বুঝবেন আবার মশলা দেওয়ার পালা! 

এবারে   

 – গোল মরিচের গুঁড়ি সোয়া চা চামুচ

 – ১/২ টা জয়ফলের গুঁড়ি (না ভেজে)

 – আনুমানিক ২/৩ গ্রাম জয়ত্রি

 – ভাজা জিরার গুঁড়ি সোয়া চা চামুচ

 – গরম মসলার গুঁড়ি: সোয়া চা চামুচ

 – মসলার গুঁড়ি: সোয়া চা চামুচ

এই সব মসলাগুলো দিয়ে আবার মাংসটা ভালভাবে নেড়ে দিন। দুই/তিন মিনিট ধরে উচ্চতাপে ভালভাবে মাংসটা নেড়ে নেড়ে কষিয়ে নিন। 

৫। এরপরে চুলার আঁচ এক্কেবারে কমিয়ে ঢাকনা দিয়ে মাংসটা চুলার উপরেই রেখে দিন। 

৬। এদিকে ফোড়নের প্রস্তুতি নিতে থাকুন। 

ফোড়নে প্রয়োজন- 

 – সরিষার তেল ১/২ কাপ

 – সোয়া কাপ পেঁয়াজ কুচি

 – রসুন কুচি ১/২ টেবিল চামুচ

 – আদা কুচি ১/২ টেবিল চামুচ

 – ৫/৬ টি শুকনো মরিচ

চুলা উচ্চতাপে রেখে গরম প্যানে সরিষার তেল গরম করে তার মধ্যে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে দিন। অনবরত নেড়ে নেড়ে লাল লাল বেরেস্তার মত করে নিন। যখন রংটা একটু বদলে আসবে তখন দিয়ে দিতে হবে রসুন কুচি, আদা কুচি আর শুকনা মরিচ। এই সবকিছু নাড়তে থাকুন যতক্ষণ পর্যন্ত পেঁয়াজের রংটা একদম বাদামি না হয়ে আসে। 

৭। এই সময় সরিষার তেলের ফোড়নটা আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা মাংসের মধ্যে দিয়ে ভালভাবে নেড়ে দিন। এবং ঢাকনা দিয়ে ৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। এতে ফোড়নের দারুণ ফ্লেভারটা সব মাংসে ভালভাবে ঢুকে যাবে। 

৮। ৫ মিনিট পর ঢাকনা খুলে দিন এবং কষিয়ে নিন, যতক্ষণ পর্যন্ত না পানি শুকিয়ে তেলটা বোঝা যায় আর মাংসটার রংটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ততক্ষণ। 

৯। এ পর্যায়ে আবারো এবং শেষবারের মত কিছু উপাদান দেওয়ার পালা। 

– কাঁচা পেঁয়াজ: ১/২ কাপ (বড় কিউব করে কাটা)

– গরম মসলার গুঁড়ি: সোয়া চা চামুচ

– রাঁধুনি মসলার গুঁড়ি: সোয়া চা চামুচ

এগুলো মাংসে দিয়ে ভালভাবে কশিয়ে নিন যতক্ষণ পর্যন্ত সদ্য দেওয়া পেঁয়াজের রংটা একটু বদলে না যায়। এরপর চুলা বন্ধ করে ঢাকনা দিয়ে ৫ মিনিট অপেক্ষা করুন।

১০। এবার?……পরিবেশনের পালা! 

এত এত বাঙালি খাবারের মধ্যেও কালাভুনার রয়েছে একটা নিজস্ব দাম ও জনপ্রিয়তা, যা যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্যপ্রিয় মানুষের কল্যাণে প্রিয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। 

আর এখন তো ঘরেই তৈরি করা যায় সুস্বাদু কালা ভুনা। প্রয়োজন শুধু একটু ধৈর্য আর খাঁটি মসলার!

Leave a Reply